মুরগির খামারে জীব-নিরাপত্তা

মুরগির খামারে জীব-নিরাপত্তা / Bio-security in poultry farm

আমাদের দেশের প্রায় সকল পোলট্রি খামারে কোন না কোন রোগের প্রাদূর্ভাব রয়েছে। পোলট্রি খামারিদের জীব-নিরাপত্তা (Bio-security) সমন্ধে সঠিক ধারনা না থাকা বা জীব-নিরাপত্তার বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে পেলট্রি খামারে রোগ প্রতিরোধ করা খুবই দূঃসাধ্য। পোলট্রি খামারিদের অবশ্যই জেনে নেওয় দরকার যে, কোন ধরনের রোগের কারণে তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় ও ঐ সকল রোগ কিভাবে খামারের মুরগিতে সংক্রামিত হয়। অনেক রোগ জীবাণু রয়েছে কতোকগুলো বাতাসের মাধ্যমে খামারের মুরগিতে কিংবা এক খামারের মুরগি থেকে অন্য খামারের মুরগিতে সহজে বিস্তার লাভ করে ।

পোলট্রি খামারে ব্যবহৃত পোলট্রি খাদ্য, খাবার পানি , খাদ্য ও খাবারের পানির পাত্র, খাদ্য পরিবহণের গাড়ী, লেয়ার মুরগির ডিমের ট্রে ,খামারে নিযুক্ত কর্মচারি ,খামার পরিদর্শনকারি ও দর্শনার্থীর মাধ্যমে রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এছাড়াও খামারের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে বা খামারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এসব প্রাণি বিশেষ করে কুকুর, বিড়াল , শেঁয়াল , ইঁদুর , গন্ধ মুষিক , গৃহপালিত পশু -পাখি , বন্য পাখি এমনকি মশা-মাছির মাধ্যমেও পোলট্রি খামারে রোগ জীবাণু ছড়াতে পারে। তাই একজন সচেতন পোলট্রি খামারিকে খামারের মুরগিকে রোগ জীবাণুর সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হলে পোলট্রি খামার পরিচালনা করতে জীব-নিরাপত্তা সমন্ধে অবশ্যই স্বচ্ছ ধারনা রাখতে হবে।

জীবন রক্ষার্থে খামারের মুরগির জন্য জীব-নিরাপত্তা খামার ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। খামারের মুরগিকে রোগ জীবাণুর সংক্রমণ থেকে রক্ষা করাই হলো জীব-নিরাপত্তার মূখ্য বিষয়। খামারে পালিত মুরগিকে জীব-নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে  খামারের মুরগিতে রোগ সংক্রমণ সম্ভবনা কমে যায় এবং খামার ব্যবস্থাপনায় খামারি লাভবান হয়। অজ্ঞতাবশতঃ খামারের জীব-নিরাপত্তা ব্যবস্থা দূর্বল হলে কিংবা জীব-নিরাপত্তা ব্যবস্থার তোয়াক্কা না করলে খামারের মুরগি সবসময় ঝুকির মধ্যে থাকবে ও খামারের আর্থিক ব্যয় বেড়ে যাবে। খামারে জীব-নিরাপত্তা ত্রুটিপূর্ণ হলেই খামার পরিচালনা অলাভজনক হবে। অতএব, পোলট্রি খামারকে লাভজনক পর্যায়ে রাখতে হলে খামারির অবশ্যই জীব-নিরাপত্তা সমন্ধে যথাযথ জ্ঞান থাকতে হবে এবং তা’ অবশ্যই দক্ষতার সাথে মেনে চলতে হবে।

পোলট্রি খামারের জীব-নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্বল্প পরিসরে আলোচনা করে শেষ করা সম্ভব নয়। নিম্নে অতি সংক্ষিপ্তাকারে পোলট্রি খামার ব্যবস্থাপনায় জীব-নিরাপত্তা সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো । সাধারণ দৃষ্টিতে পোলট্রি খামার পরিচালোনার ক্ষেত্রে জীব-নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে মোটাদাগে তিন ভাগে গুরুত্বারোপ করা যেতে পারে। যথা –

ক)  পোলট্রি শেডের অভ্যন্তরে অবস্থিত রোগ জীবাণুকে অতি দক্ষতার সাথে উপযুক্ত ও শক্তিশালী জীবাণুনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে ধ্বংস করতে হবে।

খ) পোলট্রি শেডের অভ্যন্তরে বাহির থেকে যেন কোন রোগ জীবাণু প্রবেশ করতে না পারে তা’ দক্ষভাবে মোকাবেলা করতে হবে।

গ)  শেডের সকল মুরগিকে সঠিক সময়ে উপযুক্তমানের সঠিক ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমে মুরগির দেহে দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে।

পোলট্রি শেডের অভ্যন্তরে অবস্থিত রোগ জীবাণুকে অতি দক্ষতার সাথে উপযুক্ত ও শক্তিশালী জীবাণুনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে ধ্বংস করতে হবে –

তাই সে লক্ষে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ সমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে –

১। শেডে সব সময়   ”অল ইন, অল আউট (All in, all out) “পদ্ধতিতে মুরগি পালনের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। একই শেডে বিভিন্ন বয়সের মুরগি পালন কোনভাবেই কাম্য নয়। শেডে অবস্থিত সকল মুরগি এক সাথে বিক্রয় করার পর কমপক্ষে ১৫-২১ দিন /আড়াই সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় শেডকে বিরতী প্রদানের পর শেডকে যথাযথভাবে জীবাণুমুক্তকরণ করে নতুন বাচ্চা মুরগি বা সম বয়সী মুরগি শেডে প্রবেশের সুযোগ প্রদান করতে হবে।

২। খামারের মুরগি বিক্রয় করার পরপরই বা খামারের শেড মুরগি মুক্ত করার পরেই ব্যবহৃত লিটার খামার থেকে দ্রুতই সরিয়ে ফেলতে হবে। ব্যবহৃত লিটার বস্তার ভেতর ভালোভাবে ঢুকিয়ে বস্তার মুখ ভালো করে বেঁধে পোলট্রি খামার থেকে কমপক্ষে ১.৫ কিলোমিটার দূরে কোথাও ফেলতে হবে। খামারে ব্যবহৃত লিটার কোনভাবেই খামারের পরিবেশে ফেলা যাবে না। ব্যবহৃত লিটার ফেলার সময় অবশই খেয়াল রাখতে হবে যেন অন্য কারো খামারের সংলগ্ন ফেলানো না হয়। পরিত্যক্ত লিটার বা ব্যবহৃত লিটার ফেলার সময় আরো খেঁয়াল রাখতে হবে যাতে পরিত্যাক্ত লিটার থেকে বাতাসের মাধ্যমে জীবাণু পূণরায় খামারে প্রবেশ করতে না পারে। সে লক্ষে ব্যবহৃত লিটার বাতাসের গতিপথের বিপরীতে ফেলা যাবে না। তবে খামারের ব্যবহৃত লিটার যেখানেই ফেলা হোক না কেন তা’ যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

৩। ব্যবহৃত লিটার ফেলে দেওয়ার পরেই শেডের ফ্লোর/ মেঝে প্রথমে পানি দ্বারা পরিস্কার করতে হবে। পরে উন্নতমানের জীবাণুনাশক মাত্রানুযায়ী পানিতে মিশিয়ে খামারের ফ্লোর বা মেঝে পরিস্কার করে নিতে হবে। এর পরেই খামার বা শেডকে উত্তমরূপে ফিউমিগেশন/ ধূমায়ীতকরণ করে নিতে হবে। খামারে রোগের প্রাদূর্ভাবের উপর ভিত্তি করে ফিউমিগেশন/ ধূমায়ীতকরণ মাত্রা ঠিক করে নিতে হবে। শেড ধূমায়ীতকরণ করার পরেই কেবল নতুন বাচ্চা শেডে প্রবেশ করাতে হবে। মনে রাখতে হবে শেড ফিউমিগেশন বা ধূমায়ীতকরণ করার পর শেডে কোনভাবেই প্রবেশ করা যাবে না। ব্রুডার হাউস প্রস্তুত সাপেক্ষে শেড ফিউমিগেশন বা ধূমায়ীতকরণ করতে হবে।

পোলট্রি শেডের অভ্যন্তরে বাহির থেকে যেন কোন রোগ জীবাণু প্রবেশ করতে না পারে তা’ দক্ষভাব মোকাবেলা করতে হবে।  

পোলট্রি খামারে বা শেডে বাহির থেকে রোগ জীবাণুর প্রবেশ প্রতিহত করতে হলে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ সমূহ গহণ করা যেতে পারে । যথা –

১। খামারে একাধিক শেডে একাধিক মুরগির ফ্লোক বা ঝাঁক থাকলে প্রতিটি শেডের জন্য আলাদা আলাদা কর্মচারী নিয়োগ করতে হবে। এক শেডের কর্মচারী অন্য শেডে আসা-যাওয়া বন্ধ করতে হবে। যদি কোন কারণে দরকার হয় তবে সেক্ষেত্রে খামারের কর্মচারীকে ইউনিফর্ম বা পোশাক অবশ্যই পরিবর্তন করে যেতে হবে। তবে শর্ত থাকে যে, সংশ্লিস্ট কর্মচারিকে অবশ্যই আগে কম বয়সের বাচ্চার শেডে কাজ শেষ করে পর্যায়ক্রমে বেশি বয়সের বাচ্চা কিংবা মুরগির শেডে কাজ করতে হবে। আরো শর্ত থাকে যে, খামারের কর্তব্যরত কর্মচারী আগে সুস্থ্য মুরগির শেডের কাজ শেষ করে অসুস্থ মুরগির শেডে কাজ করবে । অসুস্থ মুরগির শেডে কাজ করার পর সংশ্লিস্ট কর্মচারী কোনভাবেই সুস্থ শেডের ভিতরে প্রবেশ করতে পারবে না। কাজ শেষে সংশ্লিস্ট কর্মচারিকে তার ইউনিফর্ম বা পোশাক অবশ্যই পোশাক ধৌতাগারে ধৌত করে নিতে হবে।

২। খামারের মূল প্রবেশদ্বারে জীবাণুনাশক পানি ভর্তি অটোমেটিক বা স্বয়ংক্রিয় স্প্রেয়ার সংযোজিত থাকবে। খামারে প্রবেশ করে এমন পরিবহনের জন্য নির্দিস্ট পরিমাপের “ ফুট বাথ (Foot bath) “স্থাপন করতে হবে যাতে সংশ্লিস্ট পরিবহনের পুরো চাকা জীবাণুমুক্ত হয়। এছাড়াও খামারে কর্তব্যরত সংশ্লিস্ট সকল কর্মচারী,দর্শনার্থী,খামার পরিদর্শনকারি,পরামর্শক সহ সবাইকে  খামারের অভ্যন্তরের প্রবেশের  পূর্বে অবশ্যই খামার মালিক কর্তৃক সরবরাহকৃত পোশাক ,জুতো ,স্যান্ডেল পরিধান করে স্প্রে করা সাপেক্ষে খামারে প্রবেশের সুযোগ পাবে। দর্শনার্থী, সরকার কর্তৃক নিয়োজিত খামার পরিদর্শনকারি ও পরামর্শককে অবশ্যই অয়রন করা পোশাক ও নতুন জুতো বা পালিশ করা জুতো পরিধান করে অথবা খামার মালিক কর্তৃক সরবরাহকৃত পোশাক ও জুতো বা স্যান্ডেল পরিধান অবস্থায় খামারের অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতি পাবে। ময়লাযুক্ত পোশাক ও ছেড়া-ফাটা জুতো বা স্যান্ডেল পরিহিত অবস্থায় কোন ব্যক্তি বিশেষকে খামারের অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতি অনুমোদন যোগ্য নহে। ময়লাযুক্ত পোশাক ও ছেড়া-ফাটা বা পালিশ না করা জুতোর মাধ্যমে খামারের অভ্যন্তরে সংক্রামক রোগ জীবাণু প্রবেশ করতে পারে।

৩। পোলট্রি শেডের প্রবেশ দ্বারে আনুপাতিক হারে   জীবাণুনাশক মিশ্রিত হাত দ্বারা স্প্রে করার যন্ত্রপাতি , “ফুট বাথ এবং  হ্যান্ড ওয়াশ বাথ (Foot bath and Hand wash bath“ সার্বক্ষণিকভাবে  চালু ও সচল রাখা অত্যন্ত জরুরী।   পোলট্রি শেডের অভ্যন্তরে প্রবেশের পূর্বে সংশ্লিস্ট সকলকেই পুরো শরীরে স্প্রে ,পা ফুট বাথে চুবানো ও হাত হ্যান্ড ওয়াশ বাথে চুবিয়ে খামারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে।

৪। খামারে কর্তব্যরত কোন কর্মচারী কোন অবস্থাতেই যেখানে সেখানে ঘোরাফেরা করে খামারে বা শেডের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারবে না। বাণিজ্যিক ব্রয়লার, সোনালী, টার্কি ,হাঁস , কোয়েল বা লেয়ার মুরগির খামারিগণকেও একই নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। খামারের অভ্যন্তরে বিশেষ কোন জরুরী কারণে প্রবেশ করতে হলে তাকে অবশ্যই পোশাক ও জুতো পরিবর্তন করে স্প্রে করার মাধমে অতি সতর্কতার সহিত প্রবেশ করতে হবে। খামারের কাজের সাথে সংশ্লিস্ট কোন কর্মচারী মুরগি বা ডিমের বাজারে প্রবেশ করে পরবর্তীতে মুরগির খামারের অভ্যন্তরে কোন অবস্থাতেই  প্রবেশ করতে পারবে না।

৫। এক খামারের কর্মচারী অন্য খামারে কিংবা এক শেডরে কর্মচারী অন্য শেডে যাতায়াত কোন ভাবেই কাম্য নয়।

৬। জীবাণুমুক্ত না করেই এক খামারের যন্ত্রপাতি অন্য খামারে নেওয়া উচিৎ নয়।

৭। অসুস্থ খামারের মুরগির খাদ্য সুস্থ খামারের মুরগিকে খাওয়ানো কোন ভাবেই কাম্য নয়।

৮। খামারের মৃত মুরগি কোন অবস্থাতেই যেখানে সেখানে না ফেলে চুন সহ মাটির নিচে পুতে রাখতে হবে । যাতে কুকুর,বিড়াল বা শেয়ালের সংস্পর্শে না আসে। মৃত মুরগি সরাসরি পুড়িয়ে ফেলা অতি উত্তম কাজ। মৃত মুরগি নদীতে ,পুকুরে,ডোবায় বা যে কোন জলাশয়ে ফেলা উচিৎ নয়। এতে রোগ জীবাণুর আয়ুস্কাল বেড়ে যায় ও দ্রুত বিস্তার লাভ করে।

৯। পোলট্রি শেড এমনভাবে নির্মাণ করা দরকার যাতে শেডের অভ্যন্তরে পাখি, ইঁদুর , বিড়াল, গুইসাপ প্রবেশ করতে না পারে। কারণ এরা সরাসরি মুরগির ক্ষতি করতে পারে ও রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে থাকে।

১০। খামারের সহ্নিকটে খামারের বর্জ্য ডিসপোজ করার জন্য ডিসপোজপল পিট  (Disposable pit) থাকা খুবই জরুরী। তাতে মৃত মুরগি ডিসপোজ করতে সুবিধা হয়। এছাড়াও খামারের পরিবেশ দূর্গন্ধমুক্ত রাখতে খামার সংলগ্ন স্থানে বায়ো-গ্যাস প্ল্যান্ট (Bio-gas plant)  স্থাপন করলে ভালো হয়। খামারের এক কোনায় শেড থেকে খানিকটা দূরে মৃত মুরগির পোষ্টমর্টেম করার জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখতে হবে। বাণিজ্যিক ব্রয়লার বা লেয়ার মুরগির খামারে মৃত মুরগির পোষ্টমর্টেম শেষে তা ‘ তাৎক্ষণিকভাবে চুন সহকারে মাটির নিচে পুতে ফেলতে হবে । তবে কুকুর ,শেঁয়াল যেন গর্ত থেকে টেনে বের করতে না পারে সে বিষয়ে কড়া নজরদারি রাখতে হবে।

১১। খাদ্যের পাত্র ও পানির পাত্র পরস্কিার রাখতে হবে। খাদ্যের পাত্রে রাত্রে খাদ্য জমে থাকতে দেওয়া যাবে না। এতে খাদ্য পচে খাদ্যে ছত্রাক জন্মাবে ও সে খাদ্য খেয়ে মুরগি নানা ধরনের ছত্রাকে আক্রান্ত হবে। ছত্রাকযুক্ত খাবার খেলে মুরগির লিভার বা কলিজা অকেজো হবে। এছাড়াও বিশেষ করে ডিমপাড়া মুরগির খামারে রাতের অন্ধকারে খাদ্যের পাত্রে খাদ্য জমে থাকলে ইঁদুরের উপদ্রব বেড়ে যায় । খামারে ইঁদুরের উপদ্রব বেড়ে গেলে সালমোনেলা ও ফাউল কলেরা নামক জীবাণুর সংক্রমণ বেড়ে যায়। তাই রাতের অন্ধকারে লেয়ার মুরগির খামারের খাদ্যের পাত্রে অযথা খাদ্য জমিয়ে রাখা মোটেই কাম্য নয়।

১২। এক খামার থেকে আর এক খামারের দূরত্ব কেমন হবে তা’ সরকারী বিধান অনুসরণ করতে হবে। এক শেড থেকে আর এক শেডের দূরত্ব শেডের প্রস্থের ২.৫ গুণ হলে ভালো হয়।

১৩। খামারের চত্ত্বরে ছোট ছোট গাছ থাকলে তা’ কেটে ফেলতে হবে। তবে ছাঁয়াদানকারী কোন বড় গাছ থাকলে রাখা যেতে পারে। খামার চত্ত্বরে কোন ফুল বা ফলের বাগান করা যাবে না। অনেক বন্য পাখি আছে যারা ফুল বা ফলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে খামারে প্রবেশ করবে এবং তাদের মাধ্যমে খামারে রোগ জীবাণু ছড়াতে পারে। খামার এলাকায় সুপারি,নারকেল ও তাল গাছ থাকলে সমস্যা নেই। খামারের ভেতরে খেঁজুর গাছ না লাগানোই শ্রেয়ঃ ।

১৪। খামারের ভেতর যে কোন ভাবে দর্শনার্থীর উপস্থিতি এড়িয়ে চলতে হবে। ন্যুন্যতম প্রয়োজন ছাড়া খামারের ভেতর কোন পরিদর্শনকারী, পরামর্শদানকারীকে খামারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। কোন পোলট্রি পরামর্শককে খামারে নিতে হলে তাকে অবশ্যই খামার মালিক কর্তৃক সরবরাহকৃত পোষাক বা ইউনিফর্ম পরিধান করতে হবে।

১৫। একই ব্যক্তি খাদ্য ব্যবসায়ী ,একদিন বয়সের বাচ্চা ব্যবসায়ী ,ঔষধ ব্যবসায়ী,ব্রয়লার মুরগি ব্যবসায়ী,কালিং মুরগি ব্যবসায়ী ,ডিম ব্যবসায়ী হতে পারবেন না। একই গাড়ী বা ভ্যানে একদিন বয়সের বাচ্চা,খাদ্য,ডিম,মুরগি আনা নেওয়া করা যাবে না। ডিমের ট্রে বদল করা কোন মতেই কাম্য নয়। একই ব্যক্তি যদি এসব কাজ করতে চায় তবে তাকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আলাদা আলাদা লোকবল দ্বারা পরিচালনা করতে হবে।

১৬। খাদ্য ও পানির পাত্র কখনোই পুকুর, ডোবা বা নদীর পানিতে ধৌত করা যাবে ন্। খাদ্য ও পানির পাত্র ধৌত করতে হলে উপযুক্ত জীবাণুনাশক ব্যবহার ও প্রস্তুতকারক কোম্পানীর নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। তবে খামারের মুরগিকে যখন লাইভ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে সেক্ষেত্রে ভ্যাকসিন প্রয়োগের একদিন আগে থেকে ও ভ্যাকসিন প্রয়োগের একদিন পর পর্যন্ত পানির পাত্র ধৌতকরণের জন্য কোন প্রকার জীবাণুনাশক ব্যবহার করা যাবে না। এতে ভ্যাকসিনের কার্যকারীতা নষ্ট হবে।

১৭। মুরগির খামারে ব্যবহৃত খাবার পানি বিশুদ্ধ করণের লক্ষে প্রতি ১০০লিটার খাবার পানিতে ১ গ্রাম হিসেবে ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করা যেতে পারে। পানিতে ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করলে তা’ সাথে সাথে মুরগিকে না খাইয়ে ২ ঘন্টা পরে খাওয়াতে হবে। গরমের দিনে মুরগির খাবার পানিতে ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করলে অতিরিক্ত গরমের কারণে পানি গরম হয়ে যেতে পারে । তাই ব্লিচিং পাউডার ব্যবহারযুক্ত পানির ট্যান্ক ছায়াযুক্ত স্থানে বা ছায়াদানকারী বৃক্ষের নীচে রাখতে হবে। তবে খেয়াল রাখা দরকার য়ে, মুরগিকে লাইভ ভ্যাকসিন প্রয়োগের আগে ও পরে পানিতে ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করা যাবে না।

১৮। পোলট্রি কনসা্লট্যান্ট ও পোলট্রি বিশেষজ্ঞগণ রোগাক্রান্ত খামার পরিদর্শন করে সুস্থ খামার পরিদর্শণ করতে পারবেন না। এতে তাঁদের মাধ্যমে খামারে খামারে অতি সহজে ও দ্রুত রোগ জীবাণু সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। তবে তাঁদেরকে দিনে একাধিক মুরগির খামার পরিদর্শন করতে হলে আগে সুস্থ খামার সমূহ পরিদর্শন করতে হবে। আর খামার পরিদর্শনের পূর্বে তাঁদেরকে ইউনিফর্ম পরিধান করাতে হবে অথবা খামারে প্রবেশের পূর্বে জীবাণুনাশকযুক্ত পানি দ্বারা স্প্রে করে সাথে সাথে খামারে প্রবেশ না করিয়ে কমপক্ষে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করে খামারে প্রবেশ করতে হবে। কারণ স্প্রে করার সাথে সাথে জীবাণু মারা যায় না । জীবাণুকে মারতে হলে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও সময় লাগবে।

১৯। খামারে রোগের প্রাদূর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় খামার পরিচালনা ব্যয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। খামার পরচিালনায় অদক্ষ, অনবিজ্ঞ পরামর্শেকের কাছে পরামর্শ গ্রহণ, অপ্রয়োজনীয় এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার,রোগের বিস্তার সম্পর্কে ধারনার অভাব ও খামার পরিচালোনায় খামখেয়ালিপনাপ্রসূ মনোভাব ইত্যাদি কারণে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এ জাতীয় সমস্যা থেকে উত্তরণের লক্ষে খামারিকে সচেতন হতে হবে।

২০। বাংলাদেশের পোলট্রি খামার সমূহের অবকাঠামোগত ত্রুটি জীব-নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। বর্তমানে অনেকেই মজবুত জীব-নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে কন্ট্রোল শেডের দিকে ঝুকতে শুরু করেছে। তবে গ্রামীণ দূর্বল অবকাঠামোতে মুরগি পালন করতে হলে জীব-নিরাপত্তার বিষয়ে খামারিকে আরো সচেতন হতে হবে। খামারের পালিত মুরগিকে ভ্যাকসিন প্রয়োগের সময় ব্যাকইয়ার্ড পোলট্রিকেও (Backyard poultry)   ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। অন্যথায়, খামারের মুরগির জীব-নিরাপত্তা যে কোন মুহূর্তে ভেঙ্গে যেতে পারে।

২১। ডিমপাড়া মুরগির ক্ষেত্রে অনেক সময় দৃষ্টিগোচর হয় যে, অনেক লেয়ার মুরগির খামারিই ডিমের বাজারদর ভালো থাকলে মুরগির বয়স পেরিয়ে গেলেও মুরগি বাজারে ছাড়তে চান না । সাধারনত মুরগির বয়স ৭২ সপ্তাহ হলেই কালিং বা ছাটাই করা দরকার । মুরগির বয়স বেশি হলে বয়স্ক মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লোপ পায় । এতে বয়স্ক মুরগি নিজেই হুমকির মধ্যে থাকে ও জীব-নিরাপত্তা তাদের জন্য বড় চ্যালেন্জ হয়ে দ্বারায়। তাই জীব-নিরাপত্তার স্বার্থে বয়স্ক মুরগি যথাসময়ে ছেড়ে দেওয়াই উত্তম।

শেডের সকল মুরগিকে সঠিক সময়ে উপযুক্তমানের সঠিক ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমে মুরগির দেহে দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে ।

এ লক্ষে পোলেট্রি খামারিকে যথেষ্ট অভিজ্ঞ হতে হবে ।  নতুবা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পোলট্রি কনসালট্যান্ট বা ভেটেরিনারিয়ানের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে । মুরগির বাচ্চার দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকাংশেই নির্ভর করে ব্রিডার খামার মালিকদের ব্রিডার খামার পরিচালনার উপর। ব্রিডার মালিকদের সততা ও তাদের খামার ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বিশেষ করে ব্রিডার মুরগিকে সঠিক সময়ে সঠিক ভ্যাকসিন প্রদান করা। ব্রিডার মালিকদের ত্রুটিপূর্ণ খামার ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সঠিকভাবে ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম মেনে না চলা পরবর্তী প্রজন্মের বাচ্চা মুরগির জন্য জীব-নিরাপত্তা বড় ধরণের হুমকি হয়ে দ্বারাবে।

মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দৃঢ় করার লক্ষে সাধারন পোলট্রি খামারিদের যা করনীয় তা’ নিম্নে উল্লেখ করা হলো –

১। একদিন বয়সের আন্তর্জাতিক মানের বাচ্চা সংগ্রহ করা।

২। ব্রুডিং সময়কালীন বাচ্চাকে সঠিক তাপমাত্রা প্রদান, বাচ্চার ঘনত্ব, শেডে সঠিকভাবে বায়ু প্রবাহের সুব্যবস্থা থাকা, এমোনিয়া গ্যসের প্রভাবমুক্ত থাকা,সুপেয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা ও ছত্রাকমুক্ত খাদ্য সরবরাহ করা।

৩। মুরগির গাট হেল্থ (Gut health of chicken) সুস্থ রাখে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে এমন ধরনের প্রোবায়োটিক ও ইমিউনো মডিইলেটর ব্যবহার করা দরকার। যাতে মুরগি ককসিডিওসিস রোগে আক্রান্ত না হয়। মুরগির ককসিডিওসিস আফলাটক্সিকোসিস হলো ইমিউনোসাপ্রেসিভ রোগ। যা মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে ও ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা দূর্বল করে।

৪। রোগের প্রাদূর্ভাবের উপর ভিত্তি করে ভ্যাকসিন প্রোগ্রাম প্রণয়ন করতে হবে। তবে তা’ ঠিক করবেন সংশ্লিষ্ট এলাকার অভিজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ান । কারণ এক এক এলাকায় এক এক সময়ে এক এক ধরণের রোগের প্রাদূর্ভাব দেখা দেয় । তাই রোগের ধরণ বুঝে সংশ্লিষ্ট এলাকার অভিজ্ঞ পোলট্রি প্রাকটিশনার বা অভিজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ান ভ্যাকসিনের তালিকা প্রণয়ন করবেন। ত্রুটিপূর্ণ বা মনগড়া খেয়ালখুশিমতো মুরগিকে ভ্যাকসিন প্রদান করলে মুরগির জীব-নিরাপত্তার বত্যয় ঘটবে।

৫। সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় ও রক্তের সীরাম পরীক্ষার মাধ্যমে রাণীক্ষেত রোগের টাইটার লেভেল জেনে মানসম্মত ভ্যাকসিন প্রদান করলে মুরগির জীব-নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো সুদৃঢ় হবে ও পোলট্রি খামারিরা লাভবান হবে।

৬। মুরগিকে ভ্যাকসিন প্রদানের সঠিক নিয়মাবলী মেনে চলতে হবে। যেমন –ভ্যাকসিন সংরক্ষণ, পরিবহন,ব্যবহার বিধি,প্রয়োগ পদ্ধতি ইত্যাদি যথাযথভাবে ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের নিয়মাবলী অনুসরণ করতে হবে। প্রয়েজনে সংশ্লিষ্ট এলাকার অভিজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ানের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।